শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন
ভোলা প্রতিনিধি॥ চোর-ডাকাত আতঙ্কে নির্ঘূম রাত কাটাচ্ছে ভোলার পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়ন ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়নের জনগণ। গত ৬ মাসে ওই দুই ইউনিয়নের শতাধিক বাড়ী, দোকানপাট চুরি ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। দুটি ইউনিয়ন পাশাপাশি হওয়ায় সীমানা রোধের কারণে আইনি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ইউনিয়নের সাধারণ জনগন। এলাকার প্রভাবশালী একটি মহল এসব চোর-ডাকাত চক্রকে সেল্টার দিচ্ছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ইউনিয়নবাসীর জানমাল রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করে বিক্ষোভ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, ভোলা সদরের ৩নং পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়ন ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউনিয়ন দুটি পাশাপাশি। পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের একাংশ ৪নং ওয়ার্ড ও আলিমাবাদ ইউনিয়ন যেনো চোর-ডাকাতের এলাকায় পরিণত হয়েছে। এই দুই এলাকায় চুরি-ডাকাতির হিড়িক পড়েছে। এ যেনো চোর-ডাকাতের এক জনপদ। প্রতিদিনই ঘটছে মানুষের বাড়ি ও দোকানপাট, অটোরিকশার ব্যাটারী চুরির ঘটনা। চোর-ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় জানমালের নিরাপত্তাহীনায় পড়েছেন ইউনিয়নবাসী। এছাড়াও পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের একাংশ ও আলিমাবাদ ইউনিয়নে গত ৬ মাসে শতাধিক বাড়ী, দোকানপাট ও অটোরিকশার ব্যাটারী, মাছ ধরার ট্রলার চুরির ঘটনা ঘটেছে।
এসময় চোর ও ডাকাত চক্র লিটন বেপারীর বোরক গাড়ী, হোসেন ডাক্তারের মটর সাইকেল, ছায়েদের মটরসাইকেল, মাহাবুব ডাক্তারের ঘর ডাকাতি, ফয়ছাল মোল্লার ঘর ডাকাতি, ছোবাহান গরামীর বাড়ী ডাকাতি, কামাল রাঢ়ীর ছাগল চুরি, মসজিদের ঈমামের মটরসাইকেল চুরি, হোসেন ডাক্তারের বাড়ী ডাকাতি, মসজিদের ঈমামের সাইকেল চুরি, করিম মোল্লার মটর চুরি, জাহাঙ্গীরের টাকা চুরি, আমান উল্ল্যাহর অটোরিকশার ব্যাটারী চুরি, দুলাল সিকদারের মটর চুরি, নান্নু মোল্লার দোকান চুরি, ইউনুছ ঢালির ঘর চুরি মহাসিন মাঝির ঘর চুরি, আলাউদ্দিনের ঘর চুরি, তোফায়েল পাঠানের তিনবার দোকান চুরি, শাইন ব্যাপারীর ঘর চুরি, ইউসুফ লার্ডের বাড়ী ডাকাতি, খোরশেদ মল্লিকের দোকান চুরি করেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
বিষয়টি থানা পুলিশকে একাধিকবার জানিয়েও সীমানা বিরোধের কারণে স্থানীয় ভুক্তভোগীরা কোন প্রতিকার পাননি। দুই ইউনিয়নের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এই চোর-ডাকাত চক্রকে সেল্টার দেয় বলে স্থানীয়রা জানান। ওই দুই এলাকায় চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় মানুষ জানমালের চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী। এসময় তারা ওই এলাকায় যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারেন সে জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
জানা যায়, গত ৫ জানুয়ারী-২২ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের পক্ষিয়া এলাকার বাসিন্দা মোঃ হানিফ সর্দারের বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটে। সংঘদ্ধ চোরচক্র মোঃ হানিফ সর্দারের বাড়িতে প্রবেশ করে ফ্রীজ, পানির পাম্প, গ্যাসের চুলা, গ্যাসের বোতল, স্বর্ণালংকার, দামী আসবাবত্রপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। বিষয়টি তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং থানা পুলিশকে অবগত করেন। মোঃ হানিফ সর্দারের এক আত্মীয় চুরি হওয়া ফ্রীজটি আলিমাবাদ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের আলিমাবাদ গ্রামের মুজাম খাঁ এর ঘরে আছে জানতে পারেন। মোঃ হানিফ সর্দারের ছেলে নুর ইসলামকে বিষয়টি জানালে তিনি মেহেন্দীগঞ্জ থানা পুলিশ ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে জানান। শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারী) বিকালে পুলিশ ওই বাড়িতে এসে চুরি হওয়া ফ্রীজটি উদ্ধার করে স্থানীয় যুবলীগ সভাপতি মোঃ বাবুল বয়াতীর কাছে জিম্মায় রাখেন।
এসময় মুজাম খাঁর স্ত্রী জয়নব বিবি পুলিশকে জানান, আলিমাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ শহিদুল ইসলামের মামাতো ভাই নান্নু মৃধার ছেলে মোঃ রাফি ফ্রীজটি তার বাসায় নিয়ে আসেন। বটতলার এক অসুস্থ মহিলা ফ্রীজটি তার চিকিৎসার টাকার জন্য বিক্রি করবে বলে রাফি জয়নব বিবিকে জানান। জয়নব বিবি পার্শ্ববর্তী হারুন মাস্টারের ছেলে বাদল ও খোকনকে ডেকে এনে ফ্রীজটি ভালো কিনা দেখিয়েছেন। তারা ভালো বলার পর জয়নব বিবি রাফির কথা বিশ্বাস করে তার কাছ থেকে ফ্রীজটি ১৮ হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন। রাফিকে নগদ ৮ হাজার টাকা দেন এবং বাকি ১০ হাজার টাকা ফ্রীজের কাগজ দিলে দিবেন বলে জানিয়েছেন। জয়নব বিবি পুলিশকে আরও জানান, পুলিশ তার বাসায় আসার পর তিনি জানতে পারেন ফ্রীজটি চুরি করা। তার আগে তিনি জানতেন না বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগী হানিফ সর্দারের ছেলে নুর ইসলাম জানান, জয়নব বিবির ঘরে আমাদের চুরি হওয়া ফ্রীজটি পেয়েছি। জয়নব বিবি ফ্রীজটি ইউপি চেয়ারম্যান শেখ শহিদুল ইসলামের মামাতো ভাই নান্নু মৃধার ছেলে রাফির কাছ থেকে কিনেছেন বলে পুলিশের কাছে জানিয়েছেন। আমাদের ঘরের চুরি হওয়া ফ্রীজ, পানির পাম্প, গ্যাসের চুলা, গ্যাসের বোতল, স্বর্ণালংকার, দামী আসবাবত্রপত্র যাতে ফেরৎ পেতে পারি সে জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
এ ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত রাফির বাড়িতে গেলে রাফি ও তার পিতা নান্নু মৃধাকে পাওয়া যায়নি।
আলিমাবাদ ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মোঃ বাবুল বয়াতী বলেন, ভোলা থেকে এক মেম্বার এসে আমাকে বলে হানিফ সর্দারের ঘর থেকে চুরি হওয়া ফ্রীজটি মুজাম খাঁর ঘরে আছে। তখন আমি মুজাম খাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখি চুরি হওয়া ফ্রীজটি সেই ঘরে রয়েছে। তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করি ফ্রীজটি কার কাছ থেকে কিনেছেন।
মুজাম খাঁর স্ত্রী জয়নব বিবি আমাকে বলে, ফ্রীজটি আলিমাবাদ ইউপি চেয়াররম্যান শেখ শহিদুল ইসলামের মামাতো ভাই নান্নু মৃধার ছেলে রাফির কাছ থেকে কিনেছেন। বিষয়টি আমি মেহেন্দীগঞ্জ থানা পুলিশকে জানাই। খবর পেয়ে পুলিশের একটি টীম ওই বাড়িতে এসে চুরি হওয়া ফ্রীজটি উদ্ধার করে আমার হেফাজতে রাখেন। তিনি আরও বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামের ছত্রছায়ায় তার কিছু আত্মীয়রা ভোলার কিছু চোরের সাথে সম্পৃক্ত থেকে চুরি-ডাকাতি করে এই ইউনিয়নের চোরাই মাল আরেক ইউনিয়নে বিক্রি করে এবং আরেক ইউনিয়নের চোরাই মাল এই ইউনিয়নে বিক্রি করে।
আলিমাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি চোরের পক্ষে না। চোর যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমার ইউনিয়নে চুরির ঘটনা বেড়ে গেছে, বিষয়টি আমি উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়েছি। যারা চুরি-ডাকাতি করে তারা আমার আত্মীয় হোক বা অন্য যেই হোক তাদেরকে তথ্য প্রমাণসহ ধরতে পারলে আইনের আওতা আনা হবে। নান্নু মৃধার ছেলে রাফি যদি চুরি করে থাকে তাহলে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কোন চোর আমার আত্মীয় হতে পারেন। তবে এমন কোন চুরি অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। আসলে বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
মেহেন্দীগঞ্জ থানার ওসি বলেন, আলিমাবাদ ইউনিয়নে চুরি হওয়া একটি ফ্রীজ মুজাম খার বাসা থেকে উদ্ধার করেছি। সে স্থানীয় যুবলীগ সভাপতির বাসায় হেফাজতের রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী হানিফ সর্দার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখালে এবং তিনি অভিযোগ করলে আমরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
ইলিশা ফাঁড়ির ইনচার্জ শেখ ফরিদ বলেন, ভোলা মেহেন্দীগঞ্জের মধ্যে সীমানা বিরোধের জটিলতার কারণে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে সম্ভব হচ্ছে না। তবে হানিফ সর্দারের বাসার চুরি ঘটনায় আমাদের কাছে কোন অভিযোগ করা হয়নি। ভোলা থানায় অভিযোগ দিলে ওসির নির্দেশে দুই থানার সমন্বয় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply